ডেস্ক রিপোর্টঃ
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ২০১০ সালে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে গিয়েছিল মো. রুবেল (৩২)। ২০১৪ সালে ওই মামলার বিচারে রুবেলসহ তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। তখন থেকে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে বন্দি ছিলেন। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পরদিন কারা বিদ্রোহের সুযোগে আরও ২০২ জনের সঙ্গে পালিয়ে যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামি। অবশ্য গত ৮ আগস্ট রাজধানীর কেরানীগঞ্জ থেকে র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে ফের কারাগারে পাঠায়।
শুধু রুবেলই নয়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে ও পরে দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দিরা বিশৃঙ্খলা শুরু করে। এতে পাঁচটি কারাগারে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ করে ২ হাজার ২৪১ জন বন্দি বেরিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া এই বন্দিদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পাওয়াসহ বিচারাধীন মামলার বন্দিরাও ছিল। যদিও গত রোববার পর্যন্ত পলাতকদের মধ্যে ১ হাজার ৩১২ জনকে ফের জেলে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখনো মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনের অন্তত ৮২ বন্দিসহ ৯২৯ জন বন্দি পলাতক রয়েছে, যারা এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। কারাগার সূত্র বলছে, এসব পলাতক বন্দির বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ধর্ষ এই বন্দিরা বাইরে থাকলে ফের নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে পারে, যা আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণ হতে পারে।
অবশ্য কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন কালবেলাকে বলেন, জেল পলাতকদের বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। যারা বিশৃঙ্খলা করে পালিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা হয়েছে। তাদের কারাগারে ফেরাতে বা আইনের আওতায় নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। এরই মধ্যে বেশির ভাগই ফিরে এসেছে, আবার অনেককে গ্রেপ্তার করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
এখনো যেসব বন্দি পলাতক রয়েছে, তাদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিয়ে আইজি প্রিজন্স বলেন, দেশে বসবাস করতে হলে তাদের (এখনো যারা পলাতক) অবশ্যই আত্মসমর্পণ করতে হবে।
কারা অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে জেল পলাতকরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সেজন্য দেশের প্রতিটি ইমিগ্রেশন পয়েন্টে তাদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি চলমান অবৈধ অস্ত্রবিরোধী বিশেষ অভিযানেও এই জেল পলাতকদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
কারাগার সূত্র জানায়, পাঁচটি কারাগার থেকে বন্দিরা পালালেও চারটিতে ভেতর থেকে বিশৃঙ্খলা করেছে বন্দিরা। নরসিংদী জেলা কারাগারে বাইরে থেকে হামলা চালিয়েছিল জনতা। ওই কারাগারে ১৯ জুলাই হাজার হাজার লোক বাইরে থেকে কারা ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা কারাগারের সেলগুলো খুলে দেয় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ৯ জঙ্গিসহ প্রায় ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া এসব বন্দির মধ্যে গত ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬২২ জন আত্মসমর্পণ করেছে। পাশাপাশি তিন জঙ্গিসহ বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়। এখনো ২০৪ জন পলাতক রয়েছে।
এর বাইরে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের খবর দেশের কারাগারগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে কয়েকটি কারাগারে কয়েদি ও বন্দিরা বেরিয়ে যেতে বিক্ষোভ শুরু করে। ৬ আগস্ট গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের ভেতর রীতিমতো বিদ্রোহ শুরু করে বন্দিরা। এতে ২০৩ বন্দি পালিয়ে যায়। যাদের মধ্যে ৮৪ জন মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া বন্দি ছিল। গতকাল পর্যন্ত ২০১ বন্দি ফেরত আসেনি।
হাইসিকিউরিটি কারাগারের জেলার মোহাম্মদ লুৎফর রহমান কালবেলাকে বলেন, হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছে। প্রক্রিয়া শেষে দুজনকে কারাগারে আনা হয়েছে। ওই ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।
কারা সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় কয়েক হাজার লোক সাতক্ষীরা কারাগারের প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে। পরে তারা প্রধান ফটকের তালা ভেঙে কারাগারে ঢুকে ভেতরের সব সেল ও সাধারণ কয়েদির গেটের তালা ভেঙে আসামিদের বের করে নিয়ে যায়। ওই কারাগারে থাকা ৫৯৬ বন্দির মধ্যে আটজন বাদে সবাই বেরিয়ে যায়। এখনো ৭৩ বন্দির সন্ধান মেলেনি।
৫ আগস্ট বিকেলে একদল লোক শেরপুর জেলা কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। ওই সুযোগে কারাগারে থাকা ৫১৮ বন্দি পালিয়ে যায়। কারাগার থেকে নয়টি অস্ত্রও লুট হয়। পরে লুট হওয়া ৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা গেলেও গতকাল পর্যন্ত ৪১২ বন্দির হদিস মেলেনি। ৭ আগস্ট দুপুরে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের ভেতর বন্দিরা বিদ্রোহ শুরু করে। এক পর্যায়ে কারারক্ষীদের ওপর হামলা চালিয়ে ৯৮ বন্দি পালিয়ে যায়। গতকাল পর্যন্ত তাদের মধ্যে ৩৮ জনের হদিস মেলেনি এখনো।
কারা অধিদপ্তরের সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, জেল পলাতকদের মধ্যে যারা আইন বুঝে, যাদের শাস্তির মেয়াদ শেষের দিকে, তারা নিজেদের ইচ্ছায় ফিরে আসে। কিন্তু যারা দাগী, যারা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন পেয়ে বন্দি ছিল, তারা জানে যে, তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এজন্য এরা জেল থেকে পালাতে পারলে আর ফিরে আসতে চায় না।
সাবেক এই কারা কর্মকর্তা বলেন, জেল পলাতকরা বাইরে থাকলে কারা কর্তৃপক্ষ তো বটেই, সমাজ ও দেশের জন্যও এটা ক্ষতিকর। কারণ এরা বাইরের কোনো অশুভ শক্তির খপ্পরে পড়লে এদের দিয়ে আরও ভয়াবহ অপরাধ করানো সম্ভব। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে, তারা এই জেল পলাতক দাগি আসামিদের সহজেই ব্যবহার করতে পারবে। সেটা হওয়ার আগেই এদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
৫ আগস্ট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন, পরে কারামুক্ত হন এমন একজন ব্যক্তি কালবেলাকে বলেন, দুপুরের পরেই রাজনৈতিক বন্দিরা জেনে যান যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন। এতে গোটা কারাগারে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক বন্দি ছাড়াও শাস্তি ভোগ করা বন্দিরাও তখনই বের হয়ে যেতে চান। তবে রাজনৈতিক বন্দি বেশ কয়েক শীর্ষ নেতা সবাইকে সেখানে শান্ত করেন।
সেদিন কারাগারে দায়িত্বে ছিলেন, এমন এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত বিটিভির মাধ্যমে সরকার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর বিক্ষোভ শুরু হয়। সেদিন বন্দিদের হাতে অনেক কর্মকর্তা ও কারারক্ষী হামলার শিকার হন।
হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮৬ বন্দি: মাদারীপুরের উজ্জ্বল খান (২৯), শরীয়তপুরের মো. আল আমিন (২৮), নেত্রকোনার মুনতাসির আল জেমি (২৬), বরিশালের হুমায়ুন কবির মোল্লা (৪৩), চুয়াডাঙ্গার মো. বাহার (৪৩), গোপালগঞ্জের সাজেদুল ইসলাম (২৭), ময়মনসিংহের শরীফুল ইসলাম নাঈম (২৬), টাঙ্গাইলের শাহাদাত হোসেন (৪০), নারায়ণগঞ্জের রাজু (৩২), কুষ্টিয়ার রুবেল, জামালপুরের মো. সবুজ মিয়া (৩৮), কুষ্টিয়ার সবুজ মল্লিক (২৬), নেত্রকোনার আবুল (৫১), মৌলভীবাজারে ইদ্রিস মিয়া (৪০), নারায়ণগঞ্জের মোয়াজ্জেম হোসেন (৩০), যশোরের মো. সোহাগ (৩০), নারায়ণগঞ্জের মোসাদ্দেক ওরফে সাকে আলী (৩৮) ও মো. জাকারিয়া (৩৭), গাজীপুরের জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৮), নাটোরের মো. আব্দুল মজিদ (৩৪), চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাগর আহম্মেদ (৩১), গাজীপুরের নাইম ওরফে মহিউদ্দিন নাইম (৩০), কিশোরগঞ্জের নাজমুল (৩২), নেত্রকোনার মো. রুবেল মিয়া (৩৪), শেরপুরের আসলাম বাবু (২৮) ও আ. লতিফ (২৭), চট্টগ্রামের আবু মোকারম (৪৪), কুমিল্লার তোফায়েল আহম্মেদ (৪০), শেরপুরের আমান উল্লাহ (২৫), শরীয়তপুরের নজরুল ইসলাম (৪৮), ময়মনসিংহের সাইফুল ইসলাম (৪০), মুন্সীগঞ্জের জুলহাস দেওয়ান (৫৩), ফরিদপুরের তোফা মোল্লা (৩৬), রাজবাড়ীর আরজু মোল্লা (৪১), নেত্রকোনার ছোয়াব মিয়া (৪০), মুন্সীগঞ্জের আ. মালেক (৩২), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল মতিন (২৯), খুলনার আজিজুর রহমান পলাশ (৩৪), চাঁদপুরের আমির হোসেন (৩০), কিশোরগঞ্জের নুরে আলম (৩০), বরিশালের মো. নাছির (৩৮), ঝালকাঠির এমদাদুল হক গন্ডার (৩০), মুন্সীগঞ্জের জাহাঙ্গীর শওকত জুয়েল (৪৭), টাঙ্গাইলের রিপন নাথ ঘোষ (৪৬), গোপালগঞ্জের আব্দুল্লাহ শিকদার (২২), খুলনার মফিজুর রহমান (৩৭), রাজবাড়ীর রুবেল মণ্ডল (২৭), নারায়ণগঞ্জের ফিরোজ (৩৭), নেত্রকোনার শামীম খান (২৭), সাভার ঢাকার মো. লিটন (৪৬), কুমিল্লার ওমর ফারুক (৩৬), মানিকগঞ্জের জানে আলম (৩৩), নেত্রকোনার সাইদুল ইসলাম (৩৪), রাজশাহীর মো. সবুজ (৩৪), কিশোরগঞ্জের আবুল হোসেন (৩৭), রাজধানীর পল্লবীর শমসের (৩০), শরীয়তপুরের সোহাগ হাওলাদার (৩৩), ফরিদপুরের মনিরুল ইসলাম ওরফে রুবেল (২৮), ময়মনসিংহের রাসেল মিয়া (২৭), কক্সবাজারের গোলাম নবী ওরফে আবু (২৬), বরিশালের রুবেল (৩২), ময়মনসিংহের আনিসুর রহমান (৩৩), মাদারীপুরের সায়েদ ফকির ওরফে সাইফুল (২৭), সুনামগঞ্জের বাদল মিয়া (৩০), সিলেটের এবাদুর রহমান ওরফে পুতুল (৪৪), মানিকগঞ্জের হৃদয় ওরফে মানিক (২৮), ফরিদপুরের ইসলাম মীর (৪৩), ঢাকার আশুলিয়ার সোহেল রানা (৩২), গাজীপুরের রিপন (৩৬), ধামরাই ঢাকার ফিরোজ হোসেন (২৩), মাদারীপুরের নুর আলম মিয়া (২৭), কুষ্টিয়ার ভাংগন মণ্ডল (৩০), কিশোরগঞ্জের মো. শাহ আলম (৪০), চট্টগ্রামের বাহাদুর মিয়া (৩৫), কিশোরগঞ্জের আমিনুল হক (৩৯), শরীয়তপুরের এছাহাক ওরফে সুমন হাওলাদার (৪২), রাজধানীর পল্লবীর রাব্বী হোসেন (৩০), মানিকগঞ্জের সোহেল (২৮), পিরোজপুরের সুমন জোমাদ্দার (২৭), টাঙ্গাইলের লুকিমুদ্দিন ওরফে লোকমান (৫৪), খুলনার শাহিন মল্লিক (৩৩), শরীয়তপুরের সাকিব ওরফে বাবু (২২), সিরাজগঞ্জের আমিনুল ইসলাম (৪০), বাগেরহাটের সাইফুল ইসলাম (৩৬), রাঙামাটির মো. ইব্রাহিম (৪১), এবং চাঁদপুরের মো. মনির হোসেন (৪২)। তাদের মধ্যে র্যাব রুবেল, এমদাদুল হক গন্ডার ও লোকমান নামে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।